শূন্য হাতের কান্না
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেছেন:
فَإِنَّ مَعَ ٱلْعُسْرِ يُسْرًا إِنَّ مَعَ ٱلْعُسْرِ يُسْرًا
“নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি। আবারও বলছি, কষ্টের সঙ্গেই রয়েছে স্বস্তি।”
—(সুরাহ আল-ইনশিরাহ: ৫-৬)
কিন্তু কখনো কখনো এই স্বস্তি আসতে দেরি হয়, আর মানুষের জীবন হয়ে যায় এক দুঃখের মহাকাব্য।
গল্প: শূন্য হাতের কান্না
মাইমুনার জীবন শুরু হয়েছিল খুব সাধারণভাবে। সে ছিল এক পর্দানশীন, দ্বীনদার মেয়ে। বাবা-মায়ের আদরে বেড়ে উঠেছিল সে। কিন্তু সময় তার জন্য ভিন্ন এক বাস্তবতা লিখে রেখেছিল।
প্রথম বিয়ে: স্বপ্নভঙ্গের সূচনা
মাইমুনার প্রথম বিয়ে হয়েছিল এক দ্বীনদার ছেলে মিরাজের সঙ্গে। তার মনে আশা ছিল, জীবন হবে জান্নাতের পথের এক সুন্দর সাথী। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরেই দেখা গেল, মিরাজ ছিল খুবই গোঁড়া প্রকৃতির। ভালোবাসার বদলে শুধু কঠোরতা আর শাসনই ছিল তার কাছে স্বামীসুলভ আচরণ।
মাইমুনা ধৈর্য ধরল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ
“ধৈর্য হলো এক আলো।”
—(মুসলিম: ২২৩)
কিন্তু সেই আলো আসেনি। বরং দিনের পর দিন নির্যাতন বাড়তেই থাকল। একদিন, অত্যাচারের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে, স্বামী মিরাজ তাকে তালাক দিয়ে বের করে দিলো—শূন্য হাতে, চোখে অশ্রু নিয়ে।
দ্বিতীয় বিয়ে: আশা ও হতাশা
বাবা-মা অনেক কষ্ট করে মাইমুনার দ্বিতীয় বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। এবার স্বামী একজন ব্যবসায়ী। মাইমুনা ভাবল, এবার হয়তো সুখের দিন আসবে।
কিন্তু কিছুদিন পর সে বুঝতে পারল, তার স্বামী প্রতারণা করে টাকা উপার্জন করে। হারাম উপায়ে উপার্জিত টাকা নিয়ে সে বড়লোক সেজে থাকে।
মাইমুনা দ্বীনের পথে থাকায় এসব মেনে নিতে পারল না। সে স্বামীকে কুরআনের আয়াত শুনিয়ে সতর্ক করল:
يٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَأْكُلُوا۟ ٱلرِّبَوٰٓا۟ أَضْعَٰفًا مُّضَٰعَفَةً ۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা সুদ দ্বিগুণ-চৌগুণ করে খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।”
—(সুরাহ আল-ইমরান: ১৩০)
কিন্তু স্বামী শোনেনি। বরং মাইমুনার দ্বীনদারিত্বই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। একদিন, কোনো কারণ ছাড়াই স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দিলো। মাইমুনা আবারও পথে দাঁড়িয়ে রইল—শূন্য হাতে।
তৃতীয় বিয়ে: ভয়ংকর পরিণতি
একজন মধ্যস্থতাকারী বললেন, “মাইমুনা, এবার এমন একজনকে স্বামী বানাও, যে তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসবে।”
মাইমুনা এবার বিয়ে করল এক রুক্ষ, ছন্নছাড়া স্বামীকে। সে ছিল মাদকাসক্ত, আগের তিন স্ত্রীকে নির্যাতন করে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু মাইমুনার কপালে ছিল চতুর্থ স্ত্রীর ভাগ্য।
প্রতিদিন নির্যাতন, অভুক্ত থাকা, ঘরের দরজা আটকে রাখা—এসবই ছিল তার জীবন। সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি, একদিন তার জীবন এমন হবে।
তবু সে ধৈর্য ধরত। আল্লাহর কাছে দোয়া করত। কুরআনের আয়াত মুখস্থ করত:
إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।”
—(সুরাহ আল-বাকারা: ১৫৩)
কিন্তু ধৈর্যের সীমা একদিন শেষ হয়ে যায়। এক রাতে, তার স্বামী নেশার ঘোরে এসে তাকে এমন মারধর করল যে, সে আধমরা হয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে, তাকে রাস্তায় ফেলে রেখে স্বামী চলে গেল—এই বলে যে, “তালাক! তালাক! তালাক!”
মাইমুনা আবারও একা, পথে, শূন্য হাতে।
শেষ দৃশ্য: নিরবে কান্না
মাইমুনা ভিক্ষা করতে লাগল। একসময় কেউ তাকে আর চিনত না। সে এক মসজিদের পাশে বসে থাকত, ছেঁড়া ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে। একদিন এক শিশু এসে তার হাতে কিছু খাবার দিলো।
মাইমুনা শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তার চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছিল। সে মনে মনে বলল:
يَا أَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱصْبِرُوا۟ وَصَابِرُوا۟ وَرَابِطُوا۟ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো, সংযম অবলম্বন করো, এবং আল্লাহকে ভয় করো—যাতে তোমরা সফল হতে পারো।”
—(সুরাহ আল-ইমরান: ২০০)
তারপর সে মসজিদের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল।
মাইমুনা চলে গেল।
কিন্তু তার শূন্য হাত, তার কান্না—আজও বাতাসে ভাসে।
শেষ কথা
এ গল্প কেবল মাইমুনার নয়, এমন অনেক মেয়ের, যারা বিয়ের পর বারবার প্রতারিত হয়, অথচ ধৈর্য ধরে বেঁচে থাকে। ইসলাম নারীদের সম্মান দিয়েছে, কিন্তু কিছু মানুষ তাদের সাথে পণ্যসুলভ আচরণ করে।
কেউ কি মাইমুনাদের জন্য কিছু করবে?
আপনি কি মাইমুনাদের কান্না শুনতে পাচ্ছেন?
লেখক মাওলানা মোঃ সাকিব