নাস্তিকের প্রশ্ন ও ইসলামের জবাব (২য় খণ্ড)
![]() | |
মুসলমানদের বিভেদ ও ইসলামের অবস্থান নিয়ে নাস্তিকের প্রশ্ন এবং আলেমের সংগতিপূর্ণ জবাব |
সত্য ধর্ম কোনটি? ইসলাম কেন একমাত্র সত্য?
পরিচিতি:
ইমরান এবার আগের চেয়েও বেশি প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। গত দুটি আলোচনায় শায়খ আবদুল রাজ্জাক তাকে যে প্রমাণ ও যুক্তি দিয়েছেন, তা তার চিন্তাভাবনায় ঝড় তুলেছে। কিন্তু এখন তার সামনে আরেকটি গভীর প্রশ্ন—যদি একজন স্রষ্টা থাকেন, তাহলে তিনি কেবল ইসলামকেই কেন সত্য ধর্ম হিসেবে পাঠিয়েছেন? হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা ইহুদি ধর্ম কি তাহলে মিথ্যা?
শায়খ আগেই বুঝতে পেরেছিলেন ইমরান আজ এই প্রশ্নই তুলবে। তাই তিনি প্রস্তুত ছিলেন।
ইমরানের প্রশ্ন:
"শায়খ, আপনি যদি বলেন যে একজন স্রষ্টা আছেন, আমি সেটাকে আপাতত মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমি জানতে চাই, এত ধর্মের মধ্যে ইসলামই কেন একমাত্র সত্য হবে? সব ধর্ম তো মানুষকে ভালো কাজ শেখায়, শান্তির কথা বলে, ন্যায়ের পথে আহ্বান জানায়। তাহলে ইসলাম ছাড়া অন্যগুলো বাদ কেন?"
শায়খ আবদুল রাজ্জাকের জবাব:
শায়খ বললেন,
"প্রথমত, আমরা যদি ধরে নিই যে একজন মহান স্রষ্টা আছেন, তাহলে তার পক্ষ থেকে অবশ্যই একটি নির্ভরযোগ্য, নির্ভুল বার্তা থাকার কথা। এবং সেই বার্তা সব মানুষের জন্য, সব যুগের জন্য প্রযোজ্য হতে হবে।
চলুন ধাপে ধাপে দেখি—ইসলাম কি এই শর্ত পূরণ করে?
১. ধর্মগুলোর মধ্যে প্রেরিত গ্রন্থ ও বার্তার বিশুদ্ধতা:
শায়খ বললেন, “আমরা দেখি—ইহুদি ধর্মের মূল গ্রন্থ ‘তওরাত’, খ্রিস্টানদের ‘ইঞ্জিল’। কিন্তু এই গ্রন্থগুলো বারবার পরিবর্তন ও সম্পাদনার শিকার হয়েছে।
অথচ কুরআনের বিষয়ে আল্লাহ বলেন—
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا ٱلذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ
“নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী।” (সূরা আল-হিজর: ৯)
“কুরআন ১৪০০ বছরেও হুবহু একই আছে, এক অক্ষরও পরিবর্তন হয়নি। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার হাফেজের মুখস্থ থাকা, এক অক্ষরের ভিন্নতা না থাকা এই অলৌকিক বিষয়টি অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থে নেই।”
২. বার্তার সর্বজনীনতা ও স্থায়িত্ব:
শায়খ বললেন,
“খ্রিস্টান ধর্মে বলা হয়, ঈসা (আঃ) কেবল বনী ইস্রাইলের জন্য প্রেরিত। তাওরাতও ছিল ইহুদিদের জন্য।
কিন্তু ইসলাম কি বলে?
وَمَآ أَرْسَلْنَٰكَ إِلَّا رَحْمَةًۭ لِّلْعَٰلَمِينَ
“আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)
“অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু এক জাতি নয়, গোটা মানবতার জন্য প্রেরিত।”
৩. ইসলাম শুধু ধর্ম নয়, পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা:
“ইসলাম কেবল আধ্যাত্মিক উপদেশ নয়—এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, নৈতিক—সব দিক দিয়ে দিকনির্দেশনা দেয়।
ইসলামে ব্যবসা, রাজনীতি, যুদ্ধ, শান্তি, শত্রু-মিত্র, পরিবার—সবকিছুর বিধান আছে, যা অন্য ধর্মে অনুপস্থিত বা অসম্পূর্ণ।”
৪. ইসলাম মানে আত্মসমর্পণ, প্রকৃত স্রষ্টার প্রতি:
“‘ইসলাম’ শব্দের অর্থই হচ্ছে আত্মসমর্পণ। কে উদ্দেশ্য? আল্লাহ, যিনি এক, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেন না, যিনি জন্ম নেন না, যিনি সৃষ্টি হয়েছেন না—এই আকিদা কেবল ইসলামে পরিষ্কারভাবে আছে।
> قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌ
(সূরা ইখলাস)
ইমরানের বিস্ময়:
ইমরান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। “আমি কখনো ভাবিনি এত সুস্পষ্টভাবে এগুলো ব্যাখ্যা করা যায়। আমি ভাবতাম সব ধর্মই সমান ভালো। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য আছে। ইসলাম সত্য হওয়ার পক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে।”
শায়খ মুচকি হেসে বললেন,
“এটাই হচ্ছে সত্যের শক্তি। আল্লাহ চান মানুষ যেন নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে সত্য খুঁজে পায়। আর ইসলাম হচ্ছে সেই সত্য—যা কেবল বিশ্বাস নয়, প্রমাণ ও বুদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত।”
@@@
(“তাহলে কেন মুসলমানদের মধ্যেই এত ভেদাভেদ ও অবিশ্বাস?”)
নাস্তিকের প্রশ্ন ও ইসলামের জবাব।
মুসলমানরাই যদি সত্যের অনুসারী হয়, তাহলে তাদের মধ্যেই এত ভেদাভেদ কেন?
প্রেক্ষাপট:
ইমরান আজকের প্রশ্নে একটু আত্মবিশ্বাসী। তার মনে হচ্ছে, এবার হয়তো শায়খ আবদুল রাজ্জাক আটকে যাবেন। আগের খণ্ডে সে ইসলামকে ‘সত্য ধর্ম’ হিসেবে কিছুটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু এখন তার প্রশ্ন ধর্ম নয়, মুসলমানদের নিয়ে—যারা এই ধর্মের অনুসারী।
সে জিজ্ঞাসা করল,
“শায়খ, যদি ইসলাম সত্য ধর্ম হয়, তাহলে তার অনুসারীদের মধ্যে এত বিভক্তি, এত দল, এত মতপার্থক্য কেন? শিয়া-সুন্নি, আহলে হাদিস-হানাফি, তরিকা-পন্থা, আবার কিছু জঙ্গিবাদী দল পর্যন্ত—এসব দেখে মনে হয়, ইসলাম মানেই বিভেদ। যদি সত্য ইসলাম হতো, তাহলে তো সবাই এক হতো, তাই না?”
শায়খের ধৈর্যশীল উত্তর:
শায়খ মুচকি হাসলেন। বললেন,
“তোমার প্রশ্নটি সাধারণ মনে হলেও গভীর। কিন্তু মনে রেখো—একটি সত্য ধর্ম বা মতবাদের সঠিকতা তার অনুসারীদের আচরণ দিয়ে নয়, বরং মূল উৎস, মূল দলিল এবং প্রতিষ্ঠাতার শিক্ষার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।”
১. সত্য ধর্ম ও অনুসারীর পার্থক্য:
“প্রথমেই বুঝে নাও—একটি মতবাদ বা ধর্ম সত্য কি না, তা তার অনুসারীরা কতটা মানে বা ভাঙে, তা দিয়ে বিচার করা যায় না।
যেমন—গণিত একটি নির্ভুল বিজ্ঞান। কিন্তু কোনো ছাত্র যদি গণিতে ফেল করে, তাহলে কি বলা যাবে, গণিত ভুল?
তেমনি ইসলাম হলো স্রষ্টার পক্ষ থেকে নির্ভুল জীবন ব্যবস্থা। মুসলমানরা যদি তাতে ভিন্নমত করে, গাফেল হয়, ভুল বুঝে বা ভুল পালন করে—তাতে ইসলামের কোনো দোষ নেই।”
২. ভেদাভেদের ভবিষ্যদ্বাণী আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) করেছিলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
افترقت اليهود على إحدى وسبعين فرقة، وافترقت النصارى على اثنتين وسبعين فرقة، وستفترق أمتي على ثلاث وسبعين فرقة، كلها في النار إلا واحدة
“ইহুদিরা বিভক্ত হয়েছে ৭১ দলে, খ্রিস্টানরা ৭২ দলে, আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। এদের মধ্যে একটিমাত্র দল ছাড়া বাকি সবই জাহান্নামে যাবে।”
— (তিরমিজি: ২৬৪১)
শায়খ ব্যাখ্যা করলেন,
“অর্থাৎ বিভেদ হবে—এটা আগে থেকেই বলা হয়েছে। কিন্তু যারা সত্য পথে থাকবে, তারা হবে সেই একমাত্র দল যারা কুরআন ও হাদিসের উপর অটল থাকবে।”
৩. বিভেদের উৎস—জ্ঞানহীনতা ও খাঁটি অনুসরণ না করা:
“বিভিন্ন মত-পথের মূল কারণ হলো—
অনেকেই কুরআন-হাদিস না বুঝে মত দেয়,
কেউ ব্যক্তিগত অভিরুচিকে ধর্ম বানিয়ে ফেলে,
আবার অনেকে রাজনীতিকে ধর্মের উপর বসিয়ে দেয়।
এছাড়াও, মিডিয়া মুসলমানদের বিভেদকে বড় করে তুলে ধরে, যাতে ইসলামকে অস্থির প্রমাণ করা যায়।”
৪. ইসলামে ভিন্নমতের সীমারেখা নির্ধারিত আছে:
“ইসলাম বলে না—সবাইকে একই রকম হতে হবে। কিন্তু ইসলাম বলে, মতের ভিন্নতা যেন সত্যের সীমা ছাড়িয়ে না যায়। সাহাবীগণও কিছু বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করতেন, কিন্তু তারা ছিলেন এক উম্মাহ, এক কিবলা, এক কুরআন, এক রাসূলের অনুসারী।”
৫. সত্য দল—কারা?
ইমরান জিজ্ঞেস করল, “তাহলে সেই ‘একমাত্র দল’ কারা, যাদের রাসূল (সা.) জান্নাতি বলেছেন?”
শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বললেন,
“সেই দল হলো, যারা রাসূল (সা.) এবং সাহাবাদের পথ অনুসরণ করে। যারা কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদিসের ভিত্তিতে জীবন গঠন করে। রাসূলুল্লাহ বলেছেন—
> ما أنا عليه وأصحابي
“যার উপর আমি ও আমার সাহাবাগণ রয়েছি।” (তিরমিজি: ২৬৪১)
অতএব, বিভেদ দেখে ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ নয় বরং নিজেদের আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত।”
ইমরানের উপলব্ধি:
ইমরান এবার কিছুটা চুপ। তার চোখে বোঝা যাচ্ছে—সে ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করতে শিখেছে।
“মানে, ইসলাম বিভক্ত না, বরং মানুষ বিভ্রান্ত। আমি এসব কখনো ভাবিনি। ধন্যবাদ, শায়খ।”
শায়খ বললেন,
“সত্য জানার পথে প্রশ্ন করা দোষ নয়—শর্ত হলো, তুমি সত্য পেতে চাও কি না।”
(পরবর্তী খণ্ডে: “ইসলামে কি নারীকে ছোট করে দেখা হয়?”)
আলহামদুলিল্লাহ অনেক সুন্দর ঘটনার সাথে সাথে মাসালা শিক্ষা চালিয়ে যান পরবর্তী খন্ড পেতে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি
উত্তরমুছুনNice
উত্তরমুছুনMasaallah
উত্তরমুছুনOniq sunder
উত্তরমুছুনNice
উত্তরমুছুন